ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকে ফের তারল্য সংকটের আশঙ্কা

২০২৩ জানুয়ারি ২৯ ১৫:০২:৩৭
ব্যাংকে ফের তারল্য সংকটের আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকিং খাতে আবার বড় ধরনের তারল্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমানত প্রবাহ কমে গেছে। বেড়েছে ঋণের চাহিদা। ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার টানাটানি চলছে। নগদ টাকার ঘাটতি মেটাতে কলমানিতে সুদহার গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশে উঠেছে। অন্যদিকে ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকা তুলে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্বাচনী বছরে সরকারের নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চাপও বাড়ছে। এতেও সরকারের ঋণের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য না থাকায় সরকারের ঋণের জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে রাখার প্রবণতাও বেড়েছে।

জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকেই কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে আছে। সংকটের কারণে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারাসহ আরটিজিএস পেমেন্টেও সমস্যা হচ্ছে। সম্প্রতি ইউনিয়ন ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকে এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরটিজিএস হচ্ছে রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট বা তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া। আরটিজিএস লেনদেনের জন্য শুরুতেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখতে হয়। যাতে চেক আসার সঙ্গে সঙ্গে নিষ্পত্তি করা যায়। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যাংক টাকা না রাখে তাহলে সেই ব্যাংকের চেকও আরটিজিএসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না। মূলত তারল্য সংকটের কারণেই ব্যাংকগুলোর এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর এলসি দায় পরিশোধে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়েছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর বিনিময়ে বাজার থেকে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে তুলে নিয়েছে। ফলে আগে থেকেই চাপে থাকা ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন ব্যাংকার এবং সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে সরকারের রাজস্ব আদায়ও কম হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকারি হিসাবে যথেষ্ট অর্থ জমা নেই। যে কারণে সরকারকে ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুযারি মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত সরকারের নেট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে নেট ঋণ নিয়েছিল মাত্র ৯ হাজার ৫৬৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এ কারণে তারল্য সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।

ব্যাংকিং খাতে তারল্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বড় ভূমিকা রাখে। বিদায়ী বছরে রেমিট্যান্সে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হয়নি। একই সময়ে বৈদেশিক বিনিয়োগও কাঙ্ক্ষিত হারে হয়নি। যদিও আগের বছরে এই দুটি খাতেই অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্যের জোগান কমে গেছে। যে জন্য তীব্র তারল্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমানত সংগ্রহের গতি খুবই কম। আমানত সংগ্রহ কম এবং ঋণ বাড়ার কারণে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় গ্রাহকরা এখন ব্যাংকে টাকা রাখছেন কম। যে কারণে সংকট প্রকট হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তারল্য সংকট মেটাতে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে কাজ হবে না। ব্যাংকগুলোকেও উদ্যোগ নিতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নমনীয়তার সুযোগে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় না করে নামমাত্র ঋণ পরিশোধ করে পুনঃতপসিলীকরণ করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে নমনীয় না হয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যখন যে উপশম দেখা দেবে, তখন সেই ওধুষ দিতে হবে।

তারল্য সংকটের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী ব্যাংকসহ ইসলামী ধারার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খেতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারল্য সংকটের কারণে কলমানিতে ব্যাংকগুলোর ধার করার পরিমাণ বাড়ছে। ফলে কলমানি সুদহারও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সবশেষে গত ২৫ জানুয়ারি কলমানি বাজারে সর্বোচ্চ গড় সুদহার ছিল ৭ শতাংশ।

এদিন ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে ওভারনাইট বা এক দিনের জন্য। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদে ৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এরপর সাত দিন মেয়াদে আট দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে ৩১৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চলতি নভেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৪৮ লাখ ৬৮ হাজার ৮৮১ টাকা, যা এক মাস আগে অর্থাৎ অক্টোবর শেষে ছিল ১ কোটি ৪৯ লাখ ৪৩৩ টাকা। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৩১ হাজার ৫৫২ কোটি বা ০ দশমিক ২১ শতাংশ।

একই সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ৪২ হাজার ২৩৭ টাকা, যা গত অক্টোবর মাসে ছিল ১ কোটি ৭৪ লাখ ৫৫ হাজার ৩৪০ টাকা। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৮৬ হাজার ৮৯৭ টাকা বা ০ দশমিক ৫ শতাংশ।

আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবাহ বেশি হওয়ায় ব্যাংকে নগদ টাকার টান পড়েছে। এ ছাড়া মোট আমানতের প্রায় ১৮ শতাংশ বিধিবদ্ধ আমানত হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এর বাইরে সরকারের বিভিন্ন বিলবন্ডেও মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করা আছে। সব মিলে ব্যাংকগুলোর হাতে এখন নগদ টাকার পরিমাণ কমে গেছে। যে কারণে তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারবে কিনা সেই বিষয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এদিকে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি নিজস্ব অর্থায়নে ৫০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। এর পাশাপাশি রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার একটি আগাম অর্থায়নের তহবিল গঠন করেছে। এর মাধ্যমেই ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট মেটাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার চাহিদার পরিবর্তে জোগানের দিক থেকে বাজারে তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া আমানতের সুদহারও প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, পুনঃঅর্থায়ন এবং আগাম অর্থায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সংকট কাটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া রেপো ও রিভার্স রেপোর মাধ্যমেও ব্যাংকগুলোতে তারল্য সরবরাহের চেষ্টা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এএসএম/

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে