ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অনিয়মে চাকরি হারানো ব্যক্তিই হচ্ছেন এনসিসি ব্যাংকের এমডি!

২০২৪ মার্চ ২৫ ১৯:১৫:৩৬
অনিয়মে চাকরি হারানো ব্যক্তিই হচ্ছেন এনসিসি ব্যাংকের এমডি!

নিজস্ব প্রতিবেদক : এক সময় ঋণ অনিয়মের কারণে বেসরকারি যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখার ম্যানেজার পদ থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন শামসুল আরেফিন। বর্তমানে তাকেই এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ।

সম্প্রতি শামসুল আরেফিনকে এনসিসি ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগে অনাপত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ।

এখন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তাববি পর্যালোচনা করছে। বর্তমানে শামসুল আরেফিন এনসিসি ব্যাংকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক, কোম্পানি বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, চেয়ারম্যান, পরিচালক, কর্মকর্তা বা অন্য কোনো পদে আসীন থাকা অবস্থায় কাউকে ওই পদ থেকে অপসারণ, বরখাস্ত ও অবনমিত করা হলে তিনি কোনো ব্যাংকের এমডি ও সিইও পদে নিয়োগের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।

কিন্তু এনসিসি ব্যাংকের বর্তমান অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল আরেফিনের বিরুদ্ধে যমুনা ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত হওয়ার তথ্য গোপন করে এনসিসি ব্যাংকে নিয়োগ এবং বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিযোগ উঠেছে।

যদিও শামসুল আরেফিনের ভাষ্য, নিয়ম মেনে যমুনা ব্যাংক থেকে ক্লিন রিলিজ অর্ডার নিয়েই তিনি এনসিসি ব্যাংকে চাকরি করছেন। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র দিতে সম্মত হননি তিনি।

সম্প্রতি শামসুল আরেফিনের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে একটি অভিযোগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে। ওই অভিযোগের অনুলিপি গভর্নর, সব ডেপুটি গভর্নর ও বিএফআইইউ প্রধানকেও পাঠানো হয়েছে।

এতে বলা হয়, বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পেশাগতভাবে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়া আবশ্যক। সে লক্ষ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি

বিভাগ থেকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জারি করা নির্দেশনাপত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের যোগ্যতা ও উপযুক্ততা বিষয়ে বিধি ২ (ক) (৭)-এ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বা চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা কর্মকর্তা বা অন্য

কোনো পদে আসীন থাকা অবস্থায় তাকে স্বীয় পদ হতে অপসারণ/বরখাস্ত/অবনমিত করা হয়নি বা অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বা চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা কর্মকর্তা বা অন্য কোনো পদে আসীন থাকা অবস্থায় তাকে স্বীয় পদ হতে অপসারণ/বরখাস্ত/অবনমিত বা অব্যাহতি দেওয়া হয়ে থাকলে সেই ব্যক্তি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বা চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা কর্মকর্তা বা অন্য কোনো পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।

কিন্তু শামসুল আরেফিনের টার্মিনেশন সংক্রান্ত তথ্য গোপন করে এনসিসি ব্যাংকে অবৈধভাবে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

যমুনা ব্যাংক যে কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করেছিল, সেটা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়নি দাবি করে শামসুল আরেফিন গণমাধ্যমকে বলেন, পরবর্তী সময়ে যমুনা ব্যাংক থেকে ক্লিন রিলিজ অর্ডার নিয়ে আমি অন্য ব্যাংকে যোগদান করি।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো কর্মকর্তার টার্মিনেশন হলে এমডি হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। এই সংক্রান্ত প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, এই বিষয়ে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি। ক্লিন রিলিজ অর্ডার থাকলে এমডি হতে কোনো সমস্যা নেই। আমার কাছে যমুনা ব্যাংকের ক্লিন রিলিজ অর্ডার আছে। এরপর তার কাছে ক্লিন রিলিজের অর্ডারের কপি চাইলে তিনি সেটি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এদিকে যমুনা ব্যাংক থেকে তাকে কোনো রিলিজ অর্ডার দেওয়া হয়েছিল কিনা সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল আলম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, এটি প্রায় ১০ বছর আগের কথা। রিলিজ অর্ডার দেওয়ার বিষয়টি আমার স্পষ্ট মনে নেই। তবে রিলিজ অর্ডার পাক বা না পাক সেটা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয়। যে ব্যাংক নেবে, এটা সেই ব্যাংকের বিবেচ্য বিষয়।

তবে রিলিজ অর্ডার ছাড়া অন্য ব্যাংক নিতে পারে না, এমন তথ্যে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ব্যাংক যদি আবেদনকারী কর্মকর্তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে রিলিজ অর্ডার ছাড়াই তাকে নিয়োগ দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা নিয়ে তিনি বলেন, যে ব্যাংক নিয়োগ দেবে, সেই ব্যাংকই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেবে। এরপর আসবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তির বিষয়টি।

শামসুল আরেফিনের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে করা অভিযোগে এ কর্মকর্তার বিভিন্ন অনিয়মের ফিরিস্তিও তুলে ধরা হয়। শামসুল আরেফিন যমুনা ব্যাংকের দিলকুশা শাখার ম্যানেজার থাকা অবস্থায় বিসমিল্লাহ টাওয়েল গ্রুপসহ অনেকগুলো ঋন বিতরণে অনিয়ম এবং গ্রাহকের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করেন। যার ফলে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই যমুনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরিচ্যুত করে।

এরপর তিনি চার বছর পর্যন্ত ব্যাংকিং সেক্টরের বাইরে ছিলেন। এ অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। যমুনা ব্যাংকের সেই টার্মিনেশনের একটা কপি আমাদের সময়ের হাতে আসে। শামসুল আরেফিন বরাবর লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, রাজধানীর দিলকুশা শাখায় ম্যানেজার পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় বিসমিল্লাহ টাওয়াল গ্রুপের ঋণ হিসাবে অনিয়ম পাওয়ার দায়ে আপনাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি (টার্মিনেশন) দেওয়া হলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যাংক খাতে এমডি নিয়োগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই ওই নীতিমালা ভঙ্গ করে এমডি নিয়োগের সুযোগ নেই। ওই নীতিমালাতেই বলা আছে, ব্যাংকের এমডি হওয়ার জন্য কি কি যোগ্যতা থাকতে হবে; কি কি কারণে এমডি হওয়ার যোগ্য হবেন না। আমরা যখন এমডি নিয়োগের প্রস্তাব পর্যালোচনা করি, তখন এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে যাচাই করে দেখা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো অভিযোগে বলা হয়, যমুনা ব্যাংক কর্তৃক টার্মিনেশনের (চাকরিচ্যুতি) ঘটনাটি চাপা পড়ার চার বছর পরে শামসুল আরেফিন একটি ভুয়া, বনোয়াট, অনিয়মতান্ত্রিক ছাড়পত্র (রিলিজ অর্ডার) তৈরি করে তার অনিয়মের তথ্য গোপন করে প্রিমিয়ার ব্যাংকে যোগদান করেন। সেখানে তিনি এক বছর চাকরি করেন। এ সময়কালেও তিনি নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো প্রকার ছাড়পত্র (রিলিজ অর্ডার) ছাড়াই কোনো এক অদৃশ্য শক্তির বলে এনসিসি ব্যাংকে যোগদান করেন।

এতে আরো বলা হয়, শামসুল আরেফিন এনসিসি ব্যাংকে কিছুদিন চাকরি করে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানেও তিনি নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে তার কাছে জবাবদিহিতা চাইলে শামসুল আরেফিন তাৎক্ষণিক পদত্যাগ করেন। তখন ছাড়পত্র (রিলিজ অর্ডার) দেওয়া পর্যন্ত তাকে ব্যাংকের সকল প্রকার দৈনন্দিন কাজ থেকে, এমনকি অফিসে আসা থেকে বিরত রাখা হয়।

এছাড়া বর্তমানেও শামসুল আরেফিন এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সাথে যোগসাজশে বেনামি ঋণ পাইয়ে দেওয়ার জন্য কয়েকটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব গ্রহণপূর্বক পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করেন, যা অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমাণ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, শামসুল আরেফিনের বিরুদ্ধে পাহাড়সমান অনিয়ম অব্যস্থাপনার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও এনসিসি ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলে চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

এমন অবস্থায় নানাবিধ কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ব্যাংকিং সেক্টরকে স্থিতিশীল করার জন্য পেশাগতভাবে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে কেন্দ্রীয ব্যাংকের দৃশ্যমান পদক্ষেপ জনগণরত্যাশা পূরণে সহায়ক হবে বলেও অভিযোগের শেষাংশে উল্লেখ করা হয়।

মিজান/

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে