ঢাকা, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২

গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার পরাজয়ের কারণ

২০২৩ মে ২৭ ১২:০৮:৩৯
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার পরাজয়ের কারণ

গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী এম. গাজীপুর-৫ আসনের এমপি জাহিদ আহসান রাসেল ও মেহের আফরোজ চুমকির নৌকা ভেঙ্গে গেছে। তবে এ অঞ্চলে টঙ্গী ব্যাপক ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৮০টি কেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণে এ চিত্র দেখা গেছে।

স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের এলাকায় নৌকাবাইচের এমন হার সেখানে বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সেখানে দলীয় কোন্দলের ঘটনাও সামনে এসেছে।

যদিও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ দলীয় প্রার্থী বাছাই, ভোটারদের কাছে কাছে গিয়ে প্রচারণা না চালানো ও আজমত উল্লা খানের জনসম্পৃক্ততা কম থাকাকে অন্যতম কারণ হিসাবে দেখছে। অনেকের মতে, ভোটের আগের রাতে মার্কিন ভিসা নীতি প্রকাশও এ নির্বাচনের ফলে প্রভাব ফেলেছে।

স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা আরও জানান, গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা জাহাঙ্গীর আলমের উন্নয়ন ও তার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা তার মা জায়েদা খাতুনের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে একক সিদ্ধান্তে এ নির্বাচন করেছেন। গৃহিণী মাকে এ সিটির মেয়র নির্বাচিত করিয়েছেন।

পরাজিত হলেও জায়েদা খাতুনের জয়কে অভিনন্দন জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান। তবে তিনি পরাজয়ের কারণ নিয়ে এখনই মুখ খুলতে রাজি হননি।

আজমত উল্লা খান বলেন, সরকারের অধীনে গাজীপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। আমি জনগণের রায় মেনে নিয়েছি। নতুন নির্বাচিত মেয়রকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

তবে আমার প্রশ্ন-উনি পরাজিত হলে ফল কি মেনে নিতেন? তিনি বলেন, এ নির্বাচনে নৌকার পরাজয়ের বিষয়ে এখনই মন্তব্য করব না। দলের সবাই মিলে বসে পর্যালোচনা করে আমার প্রতিক্রিয়া জানাব।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হয়। ওইদিন গভীর রাতে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে জায়েদা খাতুন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। অপরদিকে আজমত উল্লা খান দুই লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট পেয়েছেন। তিনি ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন।

২০১৩ সালেও এ সিটি নির্বাচন করে বিএনপি সমর্থিত এমএ মান্নানের কাছে হেরেছিলেন আজমত উল্লা খান। তখনকার চেয়ে এবার তার ভোট আরও কমেছে। ওই সময়ে আজমত উল্লা খান পেয়েছিলেন ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। আর এম এ মান্নান পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট। তখন ভোটার ছিল ১০ লাখ ২৬ হাজার। এর মধ্যে ভোট পড়েছিল ৬ লাখ ৫৪ হাজার। ভোট পড়ার হার ছিল ৬৩.৬৯ শতাংশ। ভোটকেন্দ্র ছিল ৩৯২টি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা বলেন, আজমত উল্লা খানের টঙ্গীর বাইরের নেতাকর্মীদের ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা কম। সাংগঠনিক কর্মসূচি থাকলে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে গাজীপুর সদরে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আসেন।

এ ছাড়া তাকে সদর, পূবাইল, কাশিমপুরসহ অন্যান্য এলাকায় খুব একটা দেখা যায় না। অপরদিকে জাহাঙ্গীর আলম পুরো নির্বাচনি এলাকায় চষে বেড়িয়েছেন। সব এলাকায় নিজের বিশ্বস্ত কর্মীবাহিনী তৈরি করেছেন।

এবার নির্বাচনে তারাই গোপনে তার পক্ষে কাজ করেছে। এমনকি অনেকেই নৌকার ব্যাজ ধারণ করে টেবিল ঘড়ির পক্ষে কাজ করেছেন। তবে এসব বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ নেতাকর্মীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্যাহ মন্ডল বলেন, মাত্র ভোট শেষ হয়েছে। নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে সবাই ক্লান্ত। দলীয় নেতারা এখনো একসঙ্গে বসতে পারিনি। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করার এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব।

টঙ্গী পূর্ব ও পশ্চিম থানা (৪৩ থেকে ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড) এবং গাছা থানা (৩২-৩৮ নম্বর ওয়ার্ড) ও গাজীপুর সদর মেট্রো (২৩-৩১ নম্বর ওয়ার্ড) নিয়ে গাজীপুর-২ আসন। এ আসনের সংসদ-সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল। ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজীপুর সিটির মধ্যে এককভাবে টঙ্গী এলাকায় আজমত উল্লা খান বেশি ভোট পেয়েছেন।

জায়েদা খাতুনের সঙ্গে বড় ব্যবধানও তৈরি করেছেন। এ এলাকার ১৬৩টি কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন ৭৩ হাজার ৭৮৪ ভোট। অপরদিকে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ৫৫ হাজার ২৯২ ভোট। ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ ভোটারের এই এলাকায় ভোট পড়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭৭২ ভোট। টঙ্গী বাদে গাজীপুর-২ আসনের বাকি এলাকায় জায়েদা খাতুন নৌকার তুলনায় বেশি ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন।

প্রথমবার প্রার্থী হয়েই স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন। শুধু টঙ্গীতে পেয়েছেন ১৪ হাজার ৩২৯ ভোট। তার এ সংখ্যক ভোটে বিস্মিত স্থানীয়রা। তারা জানান, আজমত উল্লা খানের সঙ্গে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সরকার শাহনূর ইসলাম। তিনিও টঙ্গীর বাসিন্দা এবং প্রভাবশালী সরকার বংশের ছেলে। টঙ্গীতে আজমত উল্লা খানের ভোটব্যাংকে হাত বসিয়েছেন তিনি।

অপরদিকে সিটি করপোরেশনের ১-১৮ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে গাজীপুর-১ আসনে। এসব ওয়ার্ডে ১৩২টি কেন্দ্র রয়েছে। এ আসনের সংসদ-সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এ এলাকায় প্রধান দুই প্রার্থীর ভোট প্রায় সমান সমান। এসব এলাকায় নৌকা পেয়েছে ৬৪ হাজার ৬৮৬ ভোট। অপরদিকে টেবিল ঘড়ি পেয়েছে ৫৮ হাজার ৬১৩ ভোট।

সিটি করপোরেশনের ৩৯ থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত চারটি ওয়ার্ড পড়েছে গাজীপুর-৩ আসনের সীমানার মধ্যে। এ আসনের সংসদ-সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি। সেখানে ৩২টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে জায়েদা খাতুন বেশি ভোট পেয়েছেন। অপরদিকে আজমত উল্লা খান কম ভোট পেয়েছেন। জায়েদা খাতুনের ভোটের সংখ্যা ২০ হাজার ১৪৩টি ও আজমত উল্লার ১৫ হাজার ৫০৪টি।

প্রভাবশালীদের এলাকায় কম ভোট পাওয়ার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গাজীপুর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও নেই। টঙ্গীতেও আওয়ামী লীগের কমিটি নেই। সাবেক কমিটির সভাপতি ফজলুল হক বলেন, নির্বাচনে আমাদের কিছু ভুল থাকতে পারে। তাই ফলাফল এমন হয়েছে। টঙ্গীতে আমরা ভালো করলেও অন্য এলাকায় ভালো করতে পারিনি।

এ নির্বাচনে জায়েদা খাতুনের জয়ের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন সদ্য নির্বাচিত দুজন কাউন্সিলর। নির্বাচন করার দায়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ওই দুই নেতা জানান, তাদের দৃষ্টিতে নৌকা প্রার্থীর ভরাডুবির অন্যতম কারণ হচ্ছে জাহাঙ্গীর আলমের জনপ্রিয়তা এবং আজমত উল্লা খানের কম জনসম্পৃক্ততা।

এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াতসহ আওয়ামী লীগবিরোধীদের ভোটের সিংহভাগই জায়েদা খাতুন পেয়েছেন। আজমত উল্লার পক্ষে আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা কাজ করেছেন কি না-তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা।

এ দুই কাউন্সিলর বলেন, গাজীপুর সদর উপজেলায় ৮ লাখ ১০ হাজার ভোটার রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে এসব এলাকায় আজমত উল্লার পদচারণা ছিল না বললেই চলে। অপরদিকে এসব এলাকায় জাহাঙ্গীর আলম নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। মেয়র থাকাবস্থায় বেশিরভাগ সময় তিনি সদর এলাকায় অবস্থান করতেন।

ছেলে জাহাঙ্গীরের এমন কার্যক্রমের সুফল মা জায়েদা খাতুন পেয়েছেন। এ ছাড়াও জাহাঙ্গীরকে মেয়র থেকে বরখাস্ত, তার অনুসারীদের ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনায় সরকারি দলের প্রার্থীর ওপর প্রভাব পড়েছে। ভোটের আগে রাতে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। এতে করে নির্বাচনের আগের রাতে পুরো পরিস্থিতিই পালটে যায়।

গাজীপুর সিটি নির্বাচন শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও প্রভাব ফেলেছে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও উসকে দিয়েছে এ নির্বাচন। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপির।

এ কারণে কাউন্সিলর পদে অংশ নেওয়া ২৯ নেতাকে আজীবন বহিষ্কার করে দলটি। এমনকি কেউ যাতে ভোট দিতে না যায় এমন নির্দেশনাও দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করে নির্বাচন করে ১৫ জন সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরও নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতাকর্মীকেও ভোট দিতে দিখা গেছে।

এ বিষয়ে স্থানীয় নেতারা জানান, এমনটি হয়েছে মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে ব্যর্থতার কারণে। নির্বাচনের শুরু থেকেই তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। কাউন্সিলর পদে যেসব নেতা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের জনপ্রিয়তা বর্তমান নেতৃত্বের চেয়েও বেশি। আজীবন বহিষ্কারের আগে তাদের সঙ্গে ভালোভাবে তারা কেউ কথাই বলেননি। অর্থাৎ ভোটে না যাওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে বোঝাতে পারেননি। কারণ বর্তমান নেতৃত্ব তাদের চেয়ে জনপ্রিয় কেউ দলে থাকুক তা চাননি।

জানতে চাইলে টঙ্গী কলেজের সাবেক ভিপি ও গাজীপুর জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শরাফত হোসেন বলেন, ‘বর্তমান কমিটির কিছু ভূমিকা থাকার দরকার ছিল। সবাইকে নিয়ে একটি বর্ধিত সভা করে দলীয় নেতাকর্মীরা যাতে ভোটে অংশ না নেন, বর্জন করে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটা বর্তমান নেতৃত্ব করেনি।’

মার্কেট আওয়ার/হাবিব

ট্যাগ:

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর