ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন

২০২৩ জানুয়ারি ৩১ ১০:৫৯:০০
আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের জন্য ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে সংস্থাটির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত নির্বাহী বোর্ডের সভায় এ ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের বিষয়টি গতকাল রাতে নিশ্চিত করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই আইএমএফের প্রতি এই ঋণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিশেষ করে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আন্তোয়নেট মনসিও সায়েহ এবং মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দসহ যে দলটি এই ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ সফর করেছিল তাদের প্রতি জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছিলেন যে, আইএমএফ হয়তোবা আমাদের এই ঋণ দেবে না। তারা ভেবেছিল আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলো দুর্বল, তাই ঋণ দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। এ ঋণ অনুমোদনের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হলো যে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলো শক্ত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এবং অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আজ মঙ্গলবার আইএমএফ তাদের ওয়েবসাইটে ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে। ঘোষণায় বাংলাদেশের প্রস্তাব, ঋণের কাঠামো ও শর্তগুলোর নথি প্রকাশ করা হবে। এই প্রথম বাংলাদেশ এসব নথিপত্র প্রকাশ করার অনুমোদন দিয়েছে আইএমএফকে। এর আগে ২০১২ সালে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিলেও নথিপত্র পুরোপুরি প্রকাশ করেনি। স্বচ্ছতার স্বার্থে সরকার এসব প্রকাশ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

closeজানা গেছে, দুর্নীতি দমনসহ প্রায় ৩০টি শর্ত মেনে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিকে। এ অবস্থায় দুর্নীতি কমিয়ে আনার শর্তে রাজি হয়ে আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার।

গত ১৬ জানুয়ারি আইএমএফের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ঋণসহায়তা করার বিষয়ে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সমঝোতা হয়েছে। বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সুবিধার (ইএফএফ) আওতায় মোট ৩২০ কোটি ডলার দেওয়া হবে। আর রেজিলিয়েন্স সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় দেওয়া হবে ১৩০ কোটি ডলার। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪২ মাসের মেয়াদে সাত কিস্তিতে এ ঋণ দেওয়া হবে। ৪৪ কোটি ৭৭ লাখ ৮০ হাজার ডলারের প্রথম কিস্তি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি দেওয়া হবে। অবশিষ্ট অর্থ ৬৫ কোটি ৯১ লাখ ৮০ হাজার ডলারের ছয়টি সমান কিস্তিতে দেওয়া হবে। সূত্র জানিয়েছে, ঋণের সুদের হার ম্যাচুরিটির সময় বাজারের হারের ওপর নির্ভর করবে। অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে গড় সুদহার প্রায় ২ দশমিক ২ শতাংশ হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একগুচ্ছ শর্ত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এসব শর্ত বাস্তবায়নে দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি চলমান সংকট মোকাবিলা সহজ হবে। তারা বলেন, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে কোনো ঋণ নিলে তার যেসব শর্ত থাকে, সেগুলো ঋণ ছাড়ের আগেই পূরণ করতে হয়। আর আইএমএফের ঋণের ক্ষেত্রে শর্ত বা টার্গেটগুলো ধাপে ধাপে পূরণ করতে হয়। ঋণ অনুমোদনের আগে সরকারকে থেকে কিছু উদ্যোগ নিতে হয়েছে। এখন প্রতিটি কিস্তি ছাড়ের আগে অন্যান্য শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। আইএমএফ মিশন পরিদর্শনের মাধ্যমে নির্ধারিত শর্তের বাস্তবায়ন নিশ্চিত হয়ে কিস্তি ছাড় করবে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আইএমএফের কাছে ঋণ পেতে যে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব (লেটার অব ইনটেন্ট) দেওয়া হয়েছে, সেখানেই সরকার এ ঋণের জন্য কী কী শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে, তার ঘোষণা রয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে ঋণের ‘টার্গেট’। এ টার্গেট বা শর্ত অর্জনে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কর্মপরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী একটি প্রতিশ্রুতি পত্র দিয়েছেন। জানা গেছে, বিভিন্ন খাতে প্রায় ৩০টি টার্গেট বা শর্ত বাস্তবায়ন করবে সরকার। এ ছাড়া ঋণ প্রস্তাবে রয়েছে ‘মেমোরেন্ডাম অব ইকোনমিক অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল পলিসি বা এমইএফপি’ নামক একটি অধ্যায়। এ এমইএফপিতে বাংলাদেশ সরকার কী কী সংস্কার কার্যক্রম করবে তার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়ন নীতি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, কাঠামোগত সংস্কার, কর ও বাণিজ্যবিষয়ক সংস্কার, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সংস্কার এবং আর্থিক খাতের সংস্কার। এ ছাড়া দুর্নীতি বন্ধের মাধ্যমে স্বচ্ছতা, সুশাসন, রাষ্ট্রীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ঘোষণা রয়েছে এতে। এর সঙ্গে থাকছে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নিরাপত্তায় বিশ্বব্যাংক যেসব কাজ করার সুপারিশ করেছে, সেগুলোকেও আইএমএফ শর্ত হিসেবে নিয়েছে।

জানা গেছে, সরকার বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনার শর্তে রাজি হয়েছে। এরই মধ্যে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন, ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মুদ্রানীতি ঘোষণার শর্ত রয়েছে। এরও কিছু অংশের বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সরাসরি জনগণ থেকে বাজেট ব্যয়ের জন্য ঋণ না নেওয়া বা কমানো, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংস্কারের শর্ত বাস্তবায়ন করবে সরকার। আগামী বাজেটে এসব বিষয়ে উদ্যোগ থাকবে। দুর্নীতি বন্ধ বা কমিয়ে আনার ঘোষণা রয়েছে সরকারের। আইএমএফ ভর্তুকি ব্যবস্থাপনারও সংস্কার চায়। সংস্থাটির বক্তব্য, সরকারের ভর্তুকি যেন ধনীরা ভোগ না করে। দারিদ্র্য বিমোচনে ভর্তুকি ব্যবহার করতে হবে।

আইএমএফের অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে রাজস্ব এবং সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের মতো সামাজিক ব্যয়ের জন্য সময়সীমার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ভ্যাট আইন জাতীয় সংসদে পাস করা এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কর্মপরিকল্পনা করা। কর ছাড় কমাতে হবে এবং জ্বালানির জন্য একটি মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি তৈরি করতে হবে, যাতে স্থানীয় পণ্যের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। সত্যিকারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ও সুদের হারের সীমা আংশিক প্রত্যাহারের শর্তও রয়েছে। আইএমএফের আরেকটি শর্ত হচ্ছে কার্বন ট্যাক্স প্রবর্তন।

আইএমএফ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং বিভিন্ন ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী উপাদান ঠেকাতে নতুন এ ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়তা দিতে কাঠামোগত পরিবর্তনেও জোর দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফ বলেছে, মহামারি কাটিয়ে বাংলাদেশ জোর কদমে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয়। এতে একদিকে চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়তে থাকে, অন্যদিকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে। একই সঙ্গে, মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পায় এবং প্রবৃদ্ধির গতি কমে যায়।

বাংলাদেশ এসব তাৎক্ষণিক সমস্যা বেশ ভালোভাবে সামলে নিলেও দীর্ঘমেয়াদি কিছু গুরুতর কাঠামোগত সমস্যা রয়ে গেছে বলে মনে করে আইএমএফ, যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়া। তারা মনে করছে, সফলভাবে এলডিসি উত্তরণ নিশ্চিত করতে এবং ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের সফলতার ওপর ভর করে এগোতে হবে ও কাঠামোগত সমস্যাগুলো আমলে নিতে হবে। সেইসঙ্গে তাদের পরামর্শ, বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

আইএমএফের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি দল বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়া যাবে কিনা, তা পর্যালোচনা করতে গত ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর ঢাকা সফর করে। এরপর আইএমএফের ভাইস প্রেসিডেন্ট আন্তোয়েনেট মনসিও সায়েহ গত ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আইএমএফের ভাইস প্রেসিডেন্টের সফরের পর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম, ঠিক সেভাবে ঋণ পাচ্ছি। বাংলাদেশের জন্য মোট ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হবে।’

সোহেল/

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে